৬- বেনী-আসহ-কলা
বন্ধের দিন, মোহাম্মদ শহীদুল হক সাবের অফিস ছুটি। উনি বারান্দায় বসে চা খান, শাহ আলম পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। শহীদুল হক সাব শাহ আলমকে জিজ্ঞাস করেন সে কিছু চায় কিনা- শাহ আলম ছুটি চায়। শহীদুল হক সাব শাহ আলমকে তিন দিনের ছুটি দিয়ে দেন। তোমারে তিন দিনের ছূটি দিলাম, বল কী জন্য? কী জন্য? কারণ আমিও তিন দিন অফিসে যাবনা ঠিক করছি, বাড়িতে বিশ্রাম নিব। চারদিনের দিন সকালে আইসা পড়বা।
শাহ আলম খুশি হয়, খুশিতে আরেক কাপ চা বানিয়ে আনে। মোহাম্মদ শহীদুল হক সাব একটা বাংলা ফাইভ ধরান। আকাশটা বারবার গুঢ়গুঢ় শব্দে ডেকে উঠছে, সারারাত বৃষ্টি হয়েছে, এখনও ঝিরিঝিরি হচ্ছে। মনে হচ্ছে সময় লাগবে আকাশ পরিস্কার হতে।
শহীদুল হক সাব রাস্তায় নামেন সিগারেট শেষ করে। মোড়ের আজমলের পুরির দোকান বন্ধ দেখে একটু চিন্তিত হয়ে পড়েন। কেননা বিগত বহু বছর উনি প্রতিদিন অভ্যাশবশত এখান থেকে সিগারেট কেনেন, বিকালে পুরি খান। আজকাল ভাদাইম্যা মিজানের সাথে গল্পও করেন। শহীদুল হক সাব সামনে আগান, দেখতে পান ভাদাইম্যা মিজানের রড সিমেন্টের দোকানও বন্ধ। শহীদুল হক সাব অস্বস্তি বোধ করেন। এইরকম থমথমে পরিবেশে মনের অজান্তেই শহীদুল হক সাব বাংলা ফাইভের প্যাকেটটা পকেট থেকে বের করেন, খালি প্যাকেট দেখে তা আবার পকেটে ভরেন। শাহ আলমকে ছুটি দিয়ে ফেলেছেন এখন কেউ ফুটফরমাশ খাটার নেই। শহীদুল হক সাব হাটতে হাঁটতে রহমতগঞ্জ যান। এখানকার একটা বিরিয়ানির দোকানে দিনের বেলা চাপ দিয়ে পরাটা পাওয়া যায়। শহীদুল হক সাব রাখা বেঞ্ছে বসলেন, সামনের টেবিলে একজন এসে পানির গ্লাস ঠক করে রাখল, ঠক শব্দটা এতই তীব্র ছিল যে শহীদুল হক সাবের মাথায় ব্যাথা শুরু হয়ে গেল। চটজলদি খেয়ে উনি বাসায় চলে আসেন,বয়স কিংবা ক্লান্তির কাছে একটু তো হার মানতেই হয়।
সাহেরা আপার বাড়িতে আগুন লাগার পর কিছুদিন এলাকার দোকানপাট বন্ধ থাকে, গলিতে হৈ হুল্লোর করা পোলাপানেরা বাপ-মা’র ডরে হোক কিংবা অন্য কোন ভয়েই হোক ঘর থেকে তেমন বাইর-টাইর হয়না আরকি! এমন একটা সময়ে আমি দেখি ছাঁদের উপর জনাব মোহাম্মদ শহীদুল হক সাব দাঁড়ায় আছেন আর উলটা পাশের বাড়িতে ইতি-উতি তাকাইতাছেন, আমারে দেইখা উনি নিচে নাইমা আসে, জিগান- ‘আপ্নে তো আমারে ক্ষেতাপুরি ঐহানে লয়া গেলেন না?’ । আমি উঁনার দিকে চায়া একটু শরমিন্দা হই- কইতে থাকি-‘দেখলেন তো- এলাকায় একটা গ্যাঞ্জাম হইল, যামুনে একলগে, কবে যাইবেন কয়েন?’ শহীদুল হক সাব মুখটা কোন রকম স্বাভাবিক রাইখা একটা হাসি দিলেন, আচ্ছা বইলা উপরে চইলা গেলেন। উপরে উইঠা জনাব শহীদুল হক বিরক্ত বোধ করেন, কিন্তু কেন বিরক্ত বোধ করেন তা বুঝতে পারতেছেন না। উনি পারতপক্ষে এই এলাকার লোকজনের সাথে গায়ে পড়ে কথা বলেন না, কেন যে এই ভাদাইম্যা মিজানের সাথে কথা বলতে গেলেন ! তাও আবার ক্ষেতাপুরির কথা ,যেটা ভীষণ রকম ঝাল একটা খাবার সাথে পুদিনা-ধনেপাতার চাটনি। এটা ভেবে জনাব শহীদুল হক সাবের মাথা ঘামতে থাকে।
বিকেল থেকেই উনি মূলত বাড়ির উলটা পাশের পুরানা দুইতলা ভবনে চোখ রাখছিলেন। ভবনটা উনার বাল্যবন্ধু জয়নুলের, ওরা আমেরিকায় থাকে সপরিবারে তাই কেয়ারটেকার দেখাশোনা করত এতদিন, হঠাৎ করে ভাড়াটিয়া আসাতে উনি একটু অস্বস্তি বোধ করেন কারণ গলির শেষ মাথায় উনাদের বাড়ি আর এই বাড়িটা উলটা পাশে, একদম ডেড এন্ড, নো এক্সিট। উনি অফিস থেকে ফিরে কখনো কখনো বারান্দায় বসেন, সকালে ছাঁদে হাটেন , কেউ তেমন জ্বালায়-টালায় না। উলটা দিকের জয়নুলদের বাড়ির কার পোর্টে একটা সাদা করলো পার্ক করা, ড্রাইভার নাই আশে পাশে মনে হয়, পাশের হোস পাইপ থেকে অনবরত পানি পড়ছে। শহীদুল হক সাব আবার বিরক্ত হোন, বারান্দায় না থেকে আবার ছাঁদে উঠেন , দেখতে চেষ্টা করেন ড্রাইভার কিংবা কেয়ারটেকার কেউ আছে কিনা। এমন সময় উনি দেখতে পান ছিপছিপে শরীরের এক তরুণী হয়তো ত্রিশ হবে কি হবেনা , অনুমান করা খূব একটা কঠিন নয়, হালকা বাদামী রঙের ব্লাউজ আর সাদা-গোলাপী রঙের শাড়ি পড়া । গোলাপী-ই তো রঙটা নাকি ম্যাজেন্টা না কী বলে! ভাবতে থাকে জনাব শহীদুল হক। আজকে শাহ আলমও নাই যে ডাক দিয়া একটু খোঁজ খবর করাবেন।
শহিদুল হক বসার ঘরে বসেন টেলিফোন পাশেই, ভাবেন জয়নুলদের বাড়িতে একটা ফোন দিয়ে দেখবেন কিনা, কে জানে এতোদিনে ফোনের লাইনটা ঠিক আছে কিনা, নাকি বিল জমিয়ে কেয়ারটেকার সেটার বারোটা বাজিয়েছে!
শহিদুল সাব ফোনে নম্বর ঘুরালেন- জানালা দিয়ে ঐ বাড়ির টেলিফোনের ক্রিং ক্রিং শব্দ শুনতে পাচ্ছেন, যাক লাইটা ভাল আছে। সেন্ডেলের থপ থপ শব্দও শুনতে পারলেন, কেউ একজন গেল দৌড়ে টেলিফোনটা ধরতে। – ‘হ্যালো- আম্মা?’ শহীদুল হক থতমত খান, কী বলবেন বুঝতে পারছেন না, উনার মনে হয় এটা একটা ডিজ্যা ভ্যু – আগে শুনেছেন এই কন্ঠ কিংবা …। ঐ পাশ থেকে আবার চিৎকার আসে- ‘হ্যালো আম্মা? … হ্যালো হ্যালো… শহীদুল হক সাব সময় নেন- স্বাভাবিক করেন গলার কন্ঠস্বর- খুক করে কাশি বের হয়ে যায়। গলায় কফ জমেছে বুঝতে পারেন, খরখর কন্ঠেই বলে উঠেন- জ্বী মানে আমি শহীদুল – জয়নুলের বন্ধু । -কোন জয়নুল? -না , মানে , এই বাড়িটা আমার বন্ধু জয়নুলের । -ও আচ্ছা , স্লামালাইকুম, আমি শিখা , জয়নুল কাকা তো আমেরিকায়, আপনি জানেন তো? -হ্যাঁ জানি, জানব না কেন? আমি আপনাদের বাড়ির উলটা দিকের বাড়ি- ‘পারিজাতে’ থাকি, আমার বাড়ির ছাঁদ থেকে আপনাকে দেখে ভাবলাম ফোন দিয়ে দেখি বাড়িতে নতুন কে উঠল? – ও আচ্ছা, আমি উঠেছি কাকার বাড়িতে, আমার বাবাকে আপনি বোধ হয় চিনবেন- হাসনাত সাহেব, পিডব্লিউডি’র ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন -হ্যাঁ হ্যাঁ আমি আপনার বাবাকে চিনি , জয়নুলের কাজিন, তাইতো? উনি কেমন আছেন? -বাবা নাই , গত বছর মারা গেছেন -আর আপনার আম্মা? -আম্মা ;মাগূড়ায় থাকে , আমার কাছে আসবে কালকে – পরশু -আচ্ছা ঠিকাছে শিখা , আমি পরে একবার সময় করে আসব। আপনি কিছু লাগলে বলবেন কিংবা কেয়ার টেকার কে দিয়ে খবর পাঠিয়েন – আমার ড্রাইভার সব সময় থাকে, ওর নাম শাহ আলম। -জ্বী থ্যংক্যু, স্লামালাইকুম।
ফোন রেখে শহীদুল হক সাব চুপচাপ বসে থাকেন। নিশ্চিত হতে পারেন না শিখাই কী ছিল ঐ দিনের ফোনে? নাকি অন্য কেউ? ভাবতে ভাবতে সন্ধ্যা নেমে আসে, এলাকার নিঃস্তব্ধতা কাটেনা। চারপাশে একটা থম মেরে থাকা পরিবেশ। আজমলের পুরির দোকান খুলেছে কিনা কে জানে।