ভূষণ নদী শব্দটা শুনলেই একটা নদী দেখতে পায়। ভূষণের মনে হয় নদীটা একদমই শান্ত,ধীর আর স্থির। ভূষণের আরো মনে হয় নদীর বুকে ঢেউ কিন্তু কিনারটা পুকুরের মতো। বুক যেমনই উত্তাল কিনারটা একদমই বিপরীত। ভূষণ কেবলই নদীর কিনার ধরে হাঁটে। কখনো মাঝ নদীতে যাওয়া হয়নি। আশেপাশে কাউকে দেখাও যায় না,দেখলে ও ঠিকই জিজ্ঞাসা করত। নদীর পার ধরে বড় একটা জারুল গাছ। কিছুটা দূরে একটা কাঁঠাল গাছ।একটু দূরে আরো একটা, তারপর সারি সারি কাঁঠাল গাছ। কাঁঠালের ঘ্রাণে চারিদিক মৌ মৌ করছে, যদিও ভূষণ কাঁঠাল খায় না,গন্ধও সহ্য করতে পারে না। তাও কেন যেন রূপকুমারী নদীর পারের কাঁঠালের গন্ধ ওর দারুণ লাগে। ভূষণ একদিন অনেক ভেবে নদীটার নাম দিয়েছে রূপকুমারী। নদী কেন নদও তো হতে পারত। কিন্তু ভূষণের ধারণা, যে নদী এতো সুন্দর সে নদ হতেই পারেনা। আর নদীর বুকের ঢেউ দেখে মনে হয় সে কুমারী,সাগরের সাথে মিলন হয়নি তার এখনো। যেদিন সাগরের সাথে রূপকুমারীর সঙ্গম হবে সেদিনই রূপকুমারীর ঢেউগুলো প্রচন্ড হবে। আশেপাশের সব গ্রাম বানে ভেসে যাবে,যেন ঋতুবতী কোন কিশোরী প্রথম ঋতুর মুখোমুখি হল। ভূষণ নদীটাকে কল্পনা করে,জড়িয়ে ধরে। প্রেমিকার অভাব সে ঘুচায় নদীকে ভেবে। অলস আর নিঃসঙ্গ সময়গুলো সে এভাবেই পার করে।
ভূষণ কাজ করে পত্রিকায়,জুনিয়র ফটোগ্রাফার। রিপোর্টাররা রিপোর্ট করার সময় তাকে সঙ্গে নেয়,সে ফটাফট ফটো তুলে। মাঝে মাঝে ছুটির দিনগুলোতে ফিচার লেখে,টুকটাক বাড়তি আয় হয় তাতে। ভূষণের কেউ নেই এক ক্যামেরা আর রূপকুমারী ছাড়া। মামার কাছে বড় হওয়া ভূষণ পড়ালেখা করেছে বাবার রেখে যাওয়া জমি বিক্রি করে । তাতে মামাদেরই লাভ হয়েছে। ভূষণের চাচারা অতিশয় ভদ্রলোক,তারা ভাইয়ের জমির লোভ করেনি। ভূষণ এখন তাদের কারোর সাথেই আর যোগাযোগ রাখেনি। মাঝে মাঝে মামাতো বোন দিশা ফোন করে,ভূষণ হু হা বলে রেখে দেয়। তারপর কিছুক্ষণ রূপকুমারীকে ভেবে কাটায়। ভাবে –আচ্ছা দিশা এখন কেমন দেখতে, রূপকুমারীর মতো দিশাও কি কুমারী,ছোট ছোট ঢেউয়ের মত বুক নাকি প্রেমিকের কাছে কুমারীত্ব হারিয়েছে? দিশার বয়স এখন হয়তো তেইশ কি চব্বিশ,ভূষণের চেয়ে পাঁচ-ছয় বছরের ছোটই তো। ভূষণ ওর জন্মদিনটা জানে কিন্তু সালটা জানে না। এরপর ফোন করলে জিজ্ঞেস করতে হবে।
ভূষণ বসে আছে রূপকুমারীর পারে জারুল গাছটার নিচে। ঠান্ডা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে,হাতে জীবনানন্দের কবিতার বই। ভূষণ কিন্তু জীবনানন্দ পড়ে না,তাও কেন ওর হাতে জীবনানন্দ বুঝতে পারছে না। এরকমই হয়,রূপকুমারীর পারে বসলে ভূষণের সব এলোমেলো হয়ে আসে,নাকে লাগে কাঁঠালের মাতাল সুবাস। রূপকুমারীতে মনে হয় সারা সময়ই কাঁঠালের ফলন হয়। কি গ্রীষ্ম,কি শীত সবসময় গাছে কাঁঠাল ঝুলে। কাঁঠাল গাছগুলোর উপরের দিকে ঠিক বুকের দুপাশে দুটি করে কাঁঠাল ঝুলে যেন প্রাপ্ত বয়স্কা নারী। দিশাও কি একদিন এমন হবে,সুপুষ্ট আর ভরাট? নাকি এখনই এমন দেখতে,ভূষণ ভাবে। রূপকুমারীর আশেপাশে কাঁঠালচাপা ফুলের গাছ আছে কিনা তাও দেখা দরকার। সাথে সাথে অফিস থেকে ফোন আসে,ভূষণের ধ্যান ভাঙ্গে। হেরা গুহা থেকে ভূষণ ফিরে আসে ওর ঘরে। সিনিয়র রিপোর্টার নিঝুম জানায় পুরান ঢাকায় আগুন লেগেছে , এতো রাতে কাউকেই পাওয়া যাচ্ছে না তাই ভূষণের যেতে হবে ওর সাথে। ভূষণ জামাটা পড়ে তৈরী হয়ে নিচে নেমে আসল। নিঝুম চলে আসল মোটর সাইকেলে ,দুজন মিলে রওনা হল পুরান ঢাকার দিকে।
ভোর বেলা ছবি অফিসে প্রিন্ট করে তারপর ভুষণ বাসায় এসে ঘুমায়। ঘুমের ঘোরে ভূষণ দেখে দিশা ওর চুলে হাত বুলাচ্ছে। ভূষণের ভাল লাগে,কোন নারী এখনো ভূষণের চুলে এভাবে হাত বুলায়নি। দুপুরে ভূষণের ঘুম ভাঙ্গে। মুখ ধুয়ে,সেভ করে ভূষণ খেয়াল করল ওর ঘরে কাঁঠালচাপার ঘ্রাণ। ভূষণ জানালা দিয়ে খুঁজল আশেপাশে কোন কাঁঠালচাপার ফুলের গাছে আছে কিনা,পেল না। ভূষণ কিছুটা চিন্তিত হয়েই অফিসে চলে গেল। অফিসে পৌঁছেই ভূষণের মোবাইলে দিশার ফোন আসল,আজকে ভূষণের জন্মদিন তাই। অথচ ভূষণের মনেই ছিল না। ভূষণ একবার ভাবল দিশার সাথে দেখা করবে, আবার ভাবল এভাবে বলার দরকার নেই। দিশা আজকে কেন জানি বড্ড চুপচাপ, কিছুটা রূপকুমারীর মতো। দুই মিনিট পরেই ও ফোন রেখে দিলে ভূষনই আবার ফোন করল। ভূষণের মনে হল দিশা চাচ্ছে ওরা দেখা করুক। ভূষণ দিশাকে বলল – একবার আমার বাসায় এসে আমাকে দেখেই যাওনা কেমন আছি। দিশাকে ঠিকানা দিয়ে ভূষণ লাইন কেটে দিল।
ভূষণের রাতে বাসায় ফিরতে দেরী হল। বাসায় ঢুকে দেখে দরজার নিচ দিয়ে কে জানি একটা খাম দিয়ে গেছে। খাম খুলে দেখল দিশার চিঠি। চিঠিতে লেখা – ‘এসেছিলাম, পেলাম না। দোকান থেকে খাম আর কাগজ কিনে চিঠি দিয়ে গেলাম। মোবাইলটাও বন্ধ পাচ্ছি । মরে গেলে নাকি?’ ভূষণের ইচ্ছা করল নিজের চুল ছিঁড়ে ফেলতে,কখন যে মোবাইলটা বন্ধ হয়ে গেছে টেরই পায়নি। যদি জানত দিশা বাসায় আসবে তাহলে ও এক ছুটে বাসায় চলে আসত। ভূষণ কাপড় ছেড়ে,খাবার খেয়ে দিশাকে ফোন দিল কিন্তু পেল না। এতো রাতে ফোন না ধরাটাই স্বাভাবিক,সবাই তো আর ওর মতো নিশাচর না। এসব ভেবে ভূষণ দিশাকে নিয়ে ভাবতে শুরু করল। কেমন দেখতে হয়েছে এখন,ছোটবেলায় তো শ্যামলা আর হ্যাংলা ছিল । আস্তে আস্তে ভূষণ দিশাকে নিয়ে রূপকুমারীর পারে চলে গেল ,নগ্ন হয়ে জড়াজড়ি করে শুয়ে রইল ওরা । দিশার গায়ের কাঁঠালের ঘ্রাণ শুকতে শুকতে ভূষণ দেখতে লাগল রূপকুমারীর বড় বড় ঢেউ,হয়তো আজ রূপকুমারী সাগরের সাথে মিলিত হয়েছে।